নেতানিয়াহু যুগের অবসান

বার্তাকক্ষ প্রতিবেদন: ইসরায়েলে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর টানা এক যুগের শাসনের অবসান ঘটল। রোববার দেশটির পার্লামেন্টে নতুন সরকার গঠনের জন্য আস্থা ভোটে বিরোধী দলগুলোর জোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ায় ক্ষমতা ধরে রাখার সব আশা শেষ হলো দেশটির সবচেয়ে বেশি সময়ের শাসক নেতানিয়াহুর।

ইসরায়েলের ১২০ আসনের পার্লামেন্ট নেসেটে নেতানিয়াহুর পক্ষে ৫৯ ভোট পড়ে। আর নতুন জোট সরকার গড়ার পক্ষে ভোট পড়েছে ৬০টি। জেরুজালেম পোস্টের খবরে বলা হয়, ইতিমধ্যে জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন নাফতালি বেনেত।

স্থানীয় সময় রোববার বিকেল ৪টায় ইসরায়েলের পার্লামেন্ট নেসেটের অধিবেশন শুরু হওয়ার পর নেতানিয়াহুর পাশাপাশি বিরোধী জোটের দুই নেতা নাফতালি বেনেত ও ইয়ার লাপিদ বক্তব্য দেন। এরপর ভোটে বিরোধী জোটের পক্ষে রায় আসে। এখন নতুন সরকার গঠনের প্রক্রিয়ায় রয়েছে তারা।

এক দশকের বেশি সময় ধরে ইসরায়েলের রাজনীতিতে ডানপন্থী আধিপত্য ধরে রেখেছিলেন নেতানিয়াহু। ক্ষমতায় টিকে থাকতে ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা ও আগ্রাসন চালানোর পথ বেছে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। গত মাসেও ফিলিস্তিনের গাজায় টানা ১১ দিন বিমান থেকে বোমা ছুড়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালায় ইসরায়েলি বাহিনী।

তবে এরপরও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্যতা ফিরে পাননি নেতানিয়াহু। তাঁকে হটাতে জোট বেঁধেছে বাম, ডান ও মধ্যপন্থী দলগুলো।

নেতানিয়াহুর একসময়ের ঘনিষ্ঠজন ও তাঁর সরকারে কয়েক দফায় মন্ত্রিত্ব করা নাফতালি বেনেত মধ্যপন্থী দল ইয়েস আতিদের সঙ্গে জোট গড়তে রাজি হওয়ায় মে মাসের শেষ দিকেই নেতানিয়াহুর বিদায়ের ঘণ্টাধ্বনি বাজতে শুরু করে।

এখন ইসরায়েলের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হবেন ইয়েমিনা পার্টির নেতা নাফতালি বেনেত। পার্লামেন্টে বেনেতের দলের মাত্র ছয়টি আসন থাকলেও গত মার্চে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসন পাওয়া দল ইয়েস আতিদের সরকার গঠনের জন্য তাঁর সমর্থন জরুরি হয়ে পড়েছিল। ইয়েস আতিদের নেতা ইয়ার লাপিদের সঙ্গে বেনেতের যে চুক্তি হয়েছে, তাতে চার বছর মেয়াদের এই সরকারে প্রথম দুই বছর প্রধানমন্ত্রী হবেন বেনেত। তার পরের দুই বছর প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসবেন লাপিদ।

রোববার নেসেটে আস্থা ভোট সামনে রেখে শনিবার রাতেই জেরুজালেমে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বাসভবনের সামনে উৎসব শুরু করেন বিরোধী শিবিরের কর্মী–সমর্থকেরা। আল–জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর এখানে প্রতি সপ্তাহেই নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হতো। এখন সেখানে দেয়ালজুড়ে একটি কালো ব্যানার টাঙানো রয়েছে। তাতে লেখা রয়েছে, ‘বাই–বাই, বিবি, বাই–বাই’। নেচে–গেয়ে, ড্রাম বাজিয়ে সেখানে চলছে উৎসব।

ওফির রোবিনস্কি নামের একজন আল–জাজিরাকে বলেন, ‘আমাদের জন্য এটা অনেক তাৎপর্যপূর্ণ একটি রাত। আগামীকাল হবে আরও তাৎপর্যপূর্ণ দিন। আনন্দে আমার কান্না চলে আসছে। আমরা এটার (নেতানিয়াহুর বিদায়) জন্য শান্তিপূর্ণভাবে লড়াই করেছি।’

ইসরায়েলের কেন্দ্রীয় অঞ্চল থেকে এসে এই উৎসবে যোগ দিয়েছেন মায়া অ্যারিয়েলি নামের একজন। তিনি বলেন, ‘আমরা নাগরিকদের লড়াইয়ের বছর উদ্‌যাপন করছি। সবাই আমাদের বলত যে এতে লাভ হবে না। কিন্তু আগামীকাল ইসরায়েলে শেষ পর্যন্ত একটি নতুন সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে। এতে প্রমাণিত হয় যে নাগরিকদের লড়াইয়ে কাজ হয়।’

যেভাবে পতন
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইসরায়েলের নেতা হিসেবে পরিচিত মুখ হয়ে ওঠা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু পাঁচ দফায় দেশটির প্রধানমন্ত্রিত্ব করেছেন। ডানপন্থী দল লিকুদ পার্টির নেতা নেতানিয়াহু প্রথম ক্ষমতায় আসেন ১৯৯৬ সালে। এরপর ২০০৯ থেকে টানা ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী তিনি।

২০১৯ সালের এপ্রিলের আগাম ভোট দেন নেতানিয়াহু। সে সময় জোট সরকার গড়ার জন্য প্রয়োজনীয় সমর্থন পেতে ব্যর্থ হন তিনি। এরপর দুই দফা ভোটেও কোনো পক্ষ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। তৃতীয় দফা ভোটের পর ইসরায়েলে জাতীয় ঐক্যমতের সরকার গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা বেনি গানৎসের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে রাজি হয়েছিলেন নেতানিয়াহু। তবে গত ডিসেম্বরে ওই প্রক্রিয়া ভেস্তে যাওয়ায় নতুন করে ভোট করতে হয়।

গত মার্চে চতুর্থ দফা ভোট হয়। তাতে সবচেয়ে বেশি আসন পেলেও সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় আসন পায়নি নেতানিয়াহুর দল লিকুদ পার্টি। এরপর সরকার গঠনের ডাক পান দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসন পাওয়া ইয়েস আতিদ দলের নেতা ইয়ার লাপিদ। জোট সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সমর্থন জোগাড়ে গত ২ জুন ছিল তাঁর শেষ সময়। তার আগেই উগ্র জাতীয়তাবাদী দল নাফতালি বেনেতের সমর্থন পান তিনি।

ইসরায়েলের ১২০ আসনের পার্লামেন্টে মাত্র ৬ আসন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন উগ্র জাতীয়তা ডানপন্থী নাফতালি বেনেত। একসময়ের প্রযুক্তি উদ্যোক্তা বেনেতের ইসরায়েলের রাজনীতিতে আবির্ভাব ডানপন্থী, উগ্র ধর্মীয় ও জাতীয়তাবাদী বক্তব্যের মধ্য দিয়ে।

৪৯ বছর বয়সী বেনেত রাজনীতির পুরো সময়েই ডানপন্থী ভোটারদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করেছেন। এখন ইয়েমিনা পার্টির নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। এই দলই অধিকৃত পশ্চিম তীরের একাংশকে ইসরায়েলের অংশ হিসেবে ঘোষণা করার দাবি জানিয়ে আসছে।

আক্রমণাত্মক বক্তব্যের জন্য পরিচিত বেনেতকে ঘিরে বিতর্ক কম হয়নি। অর্থনৈতিক নীতির দিক দিয়ে তিনি অতি উদারবাদী। ইরানের বিরুদ্ধে কট্টর অবস্থান রয়েছে তাঁর। মতাদর্শের মিল থাকা নেতানিয়াহুর কয়েকটি সরকারে দায়িত্ব পালন করেছেন বেনেত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাঁদের মধ্যে বিরোধ বাড়তে থাকে।

নাফতালি বেনেত ইসরায়েলের স্পেশাল ফোর্সের সাবেক কমান্ডো। যুক্তরাষ্ট্র বংশোদ্ভূত বাবা–মায়ের ঘরে জন্ম তাঁর। এখন স্ত্রী গালিত ও চার সন্তানকে নিয়ে ইসরায়েলের কেন্দ্রীয় রানানা শহরে থাকেন তিনি।

২০০৫ সালে ১৪৫ মিলিয়ন ডলারে টেক স্টার্ট–আপ বিক্রি করে রাজনীতিতে সক্রিয় হন বেনেত। পরের বছর সে সময় বিরোধী দলে থাকা লিকুদ পার্টির নেতা নেতানিয়াহুর চিফ অব স্টাফ হন তিনি। এই দায়িত্ব ছাড়ার পর ২০১০ সালে বেনেত ইয়েশা কাউন্সিলের প্রধানের দায়িত্ব নেন। এই কাউন্সিল অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি সম্প্রসারণের লক্ষ্যে কাজ করে।

এরপর ২০১২ সালে উগ্র ডানপন্থী দল জিউস হোম পার্টির নেতৃত্বে আসেন নাফতালি বেনেত। ওই সময় পতনের মুখে থাকা এই দলকে চাঙা করেন তিনি। তাঁর নেতৃত্বে পার্লামেন্টে দলটির আসনসংখ্যা বেড়ে চার গুণ হয়। এ সময় একের পর এক ফিলিস্তিনিদের বিষোদ্‌গার করে তাঁর দেওয়া বক্তব্য সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়।

২০১৩ সালে বেনেত বলেছিলেন, ‘ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসীদের হত্যা করা উচিত, মুক্তি দেওয়া নয়।’ বেশ কয়েকবার তাঁর এসব বিতর্কিত বক্তব্য আদালত পর্যন্ত গড়ায়। একবার তিনি বলেছিলেন, পশ্চিম তীর অধিকৃত নয়, কারণ এখানে কখনো ফিলিস্তিনিদের রাষ্ট্র ছিল না। তাঁর আরেক বক্তব্য নিয়েও ঝড় উঠেছিল। তিনি বলেছিলেন, ইসরায়েল–ফিলিস্তিনিদের সংঘাতের কখনো অবসান হবে না। এটাকে মেনে নিতে হবে।

নেতানিয়াহুর সরকারে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছাড়াও অর্থ ও শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছেন নাফতালি বেনেত। ২০১৮ সালে জিউস হোম পার্টির নাম বদলে ইয়েমিনা করেন তিনি। এই দল নিয়ে নেতানিয়াহুর জোট সরকারে যোগ দিয়েছিলেন বেনেত। তবে ওই বছরই এই জোট ভেঙে পড়ে।

এরপর গত বছর মে মাসে নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন ঐক্য সরকারে যোগ দেওয়ার জন্য বেনেতকে ডাকা হয়নি। তার মধ্য দিয়ে মতাদর্শিক মিল থাকার পরও বেনেতের প্রতি নেতানিয়াহুর অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ ঘটে।

গত বছর করোনাভাইরাস সংক্রমণ দেখা দিলে স্বাস্থ্যসেবা–সংকটের দিকগুলো তুলে ধরে উচ্চকণ্ঠ হন নাফতালি বেনেত। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি করোনার অভিঘাত মোকাবিলায় অর্থনৈতিক প্রণোদনা দেওয়ার দাবি তোলেন তিনি।

ইউকে/এসএম