আর্থিক খাতে বড় সংকটের আশঙ্কা

বার্তাকক্ষ প্রতিবেদন: ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে হঠাৎ কার্যকর করা একটি আন্তর্জাতিক মান অর্থনৈতিক সংকটকে আরও ঘণীভূত করে তুলেছে বলে মনে করছেন দেশের শিল্পে বাণিজ্য খাতের উদ্যোক্তারা। নতুন এ মান অনুযায়ী খেলাপি হওয়ার সময় ছয় মাস থেকে কমিয়ে তিন মাস করা হয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এর মাধ্যমে তাদের বিপদে ফেলে দেওয়া হয়েছে।

আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড ব্যাসেল-৩ অনুযায়ী পরপর তিনবার ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করলে গ্রাহক খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। চলতি বছরের এপ্রিল থেকে ব্যাংকিং খাতে ব্যাসেল-৩ মান অনুসরণ করা হচ্ছে। আগে যা ছিল ৬ মাস। দেশের শিল্পে বাণিজ্য খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, নতুন এ ব্যবস্থা কার্যকর করার ফলে ব্যাংক খাতে আগে থেকে চলতে থাকা অর্থনৈতিক সংকট আরও ঘণীভূত হয়েছে।

উদ্যোক্তারা বলছেন, ঋণের উচ্চ সুদ হার ও গত বছরের জুলাইয়ে সরকার পতন আন্দোলনের পর থেকে ব্যবসা বাণিজ্য সংকটের মধ্যে যাচ্ছে। এর আগেই রিজার্ভ কমে গেছে এবং ডলারের বিপরীতে টাকার বড় পতন হয়েছে। এমন অবস্থায় অনেকে কোনোমতে টিকে থাকলেও খেলাপি হওয়ার সময় ছয় মাস থেকে কমিয়ে তিন মাস করায় সংকট আরও গভীর হচ্ছে।

বিষয়টি ‘দুর্বল শিক্ষার্থীকে পাস করানোর ব্যবস্থা না করে পাসের নম্বর বাড়িয়ে দিয়ে বিপদে ফেলে দেওয়ার মতো’ বলে মনে করছেন নীট তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমই) সাবেক সভাপতি ফজলুল হক।

তিনি বলেন, ‘আর্থিক খাতের পুরো সিস্টেম ঠিক না করে যদি ব্যাসেল-৩ মান কার্যকর করার উদ্যোগ ভালো হয়নি। ঋণ খেলাপি হওয়ার মূল কারণ চিহ্নিত করে সমাধানের উদ্যোগ না নিয়ে এটা করা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের বিজনেস সিস্টেম বিশ্বমানের না। ঋণ ব্যবস্থাপনা বিশ্বমানের না হতেই আদায়ের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান কার্যকর করা হয়েছে। গত আগস্টে ব্যবসা বাণিজ্যে যে বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি হয়েছিল, তারপর থেকে আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়নি। এই সময়ে এ ধরনের উদোগ নেওয়া যুক্তিসঙ্গত কাজ হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘ঋণ দেওয়ার সময় সতর্ক হওয়া, নার্সিং করা ও গ্রাহকের সমস্যার সমাধানের দিকে নজর দেওয়ার দরকার ছিল। যারা ঋণ বিদেশে পাচার করে আর যে ব্যবসায়ীরা ঋণ নিয়ে যৌক্তিক কারণে ব্যবসা করতে পারেনি, তাদের এক পাল্লায় মাপলে হবে না। এটা সেই পাসের উপযোগী না করে পাসের মার্ক বাড়িয়ে দেওয়ার মত।’

ফজলুল হক বলেন, ‘অনেক ভালো ব্যবসায়ী কষ্ট করে হলেও ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিলেন, ঋণ পরিশোধ করছিলেন। কিন্তু তারা এখন আর ঋণ পাচ্ছেন না। ঋণ পরিশোধের সময় কমিয়ে আনার ফলে অনেকে নতুন করে খেলাপি হচ্ছেন।’

সর্বশেষ ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। দেশে সর্বশেষ গত জুন প্রান্তিকে খেলাপি ঋণের পরিমান ৩০ শতাংশের ওপরে। যদিও নির্দিষ্ট সময়ের দুই মাস অতিবাহিত হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক এই তথ্য এখনো প্রকাশ করেনি। আগের প্রান্তিক ও ব্যাসেল৩ কার্যকর শুরুর সময় মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের পরিমান ছিল ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৪.১৩ শতাংশ। আগের সরকারের সময়ে ব্যাংকিং খাতজুড়ে লুটপাট, খেলাপি ঋণ ঠেকিয়ে রাখার কারণে এই খাতের করুণ পরিনতি হয়েছে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক মান ব্যাসেল৩ কার্যকর শুরুর আগে আর্থিক খাতকে প্রস্তুত না করা, দেশের অর্থনীতির সংকটময় পরিস্থিতি অতিক্রম না করেই খেলাপি হওয়ার সময় কমিয়ে আনায় খেলাপির এই ভয়ংকর আকার ধারণ করতে সহায়তা করেছে। খেলাপি ঋণের এই ভয়ংকর চিত্র প্রকাশের আগেই দুই শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণ পূণর্গঠন কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, হাসিনা সরকারের পতনের সময় খেলাপি ঋণের পরিমান ছিল ১ লাখ ৬৭ হাজার ৮৮৯ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৯.৯৭ শতাংশ। অন্তর্ববর্তী সরকারের এক বছরে খেলাপি হয়েছে ২০ শতাংশ, যা ব্যাংকিং খাতের অভ্যন্তরীণ সংকটকে প্রকট করে তুলেছে।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, ‘ব্যাসেল–৩ মান আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সতর্কতা ছাড়া এই আন্তর্জাতিক ঋণনীতির মান যদি হঠাৎ প্রয়োগ করা হয়, তাহলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক বেড়ে যেতে পারে। এতে দেউলিয়া ব্যবসার সংখ্যা বাড়বে, যা অর্থনীতিতে বড় ধরনের অস্থিরতা ও বেকারত্ব সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোতে (সিআইবি) খেলাপি হিসাবে নিবন্ধিত ব্যবসায়ীর সংখ্যা বেড়ে যাবে। একবার কোনো উদ্যোক্তা বা প্রতিষ্ঠান সিআইবিতে খেলাপি হিসেবে তালিকাভুক্ত হলে, তাদের সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কোম্পানিও নতুন করে ব্যাংক ঋণ পাবে না। এতে তারাও খেলাপির ঝুঁকিতে পড়বে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সিআইবিতে খেলাপি চিহ্নিত করার নিয়ম পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে ঋণ পুনর্গঠন ও সুদ মওকুফের সুযোগ দিতে হবে, প্রয়োজনে দেউলিয়া ঘোষণার প্রক্রিয়ায় সহায়তা করতে হবে। এতে ঋণ পুনর্গঠন ও খেলাপি ঋণ সমাধানের পথ তৈরি হবে।’

এই অস্বাভাবিক খেলাপি ঋণের মধ্যেই আন্তর্জাতিক মান অনুসরণের ফলে একদিকে যেমন আগের সময়ের খেলাপিদের ঋণের বোঝাও বাড়তি সুদের বোঝা তুলনামূলক ভালো গ্রাহকদের নিতে হচ্ছে, যারা নিয়মিত সুদ দিচ্ছে তাদের ওপরে আরও বাড়তি চাপ তৈরি করবে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, নতুন করে অনেক শিল্প রুগ্ন হচ্ছে। নতুন বিনিয়োগের রাস্তাও বন্ধ হচ্ছে। পাশাপাশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে আরও করুণ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। খেলাপি ঋণ বাড়লে এর তিন উপ-ধরণ সাব-স্ট্যান্ডার্ড, ডাউটফুল ও ব্যাড অ্যান্ড লসের বিপরীতে ২৫ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত প্রভিশন রাখতে হচ্ছে, যা এখনি বড় সংখ্যক ব্যাংক সংরক্ষণ করতে পারছে না। খেলাপি ঋণ আরও বাড়লে প্রভিশন ঘাটতিতে পড়া ব্যাংকের সংখ্যাও বাড়বে। এর প্রভাব বিনিয়োগকারীদের পড়বে।

আর্থিক খাতের করুণ পরিস্থিরির কারণে খাতজুড়ে উল্টো ঘটনা ঘটছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে অর্থনীতিতে সচল রেখে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে লাইফ লাইন হিসাবে কাজ করার কথা; ব্যাংকগুলো মুনাফা করার কথা। অন্যদিকে আর্থিক খাতের ‍নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেই সুবিধা নিশ্চিত করবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে মুনাফা গৌন। ব্যবসায়ী নেতারা সেই চিত্রায়ন করেছে ক্ষোভভরে।

ইউকে/জেআর/এসই