বেতন বঞ্চনায় প্রাথমিকের শিক্ষকরা

বার্তাকক্ষ প্রতিবেদন: বেতন-ভাতা বঞ্চনায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন। শিক্ষকদের আন্দোলন আরও বেগ পায় ডিসেম্বরে। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হলে তারা ‘কমপ্লিট শার্টডাউন’ দিয়ে পরীক্ষা নেওয়া থেকে বিরত থাকেন। খুদে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা না নিয়ে আন্দোলন করার সমালোচিত হন শিক্ষকরা।

শিক্ষকরা বলছেন, তারা দীর্ঘদিন বঞ্চনার শিকার হয়ে আসছেন। যৌক্তিক দাবি আদায়ে যৌক্তিক সব পন্থায় দাবি-দাওয়া উপস্থাপন করে শেষে তারা ‘কমপ্লিট শার্টডাউন’ দেন। এটা পূর্ব ঘোষিত, হঠাৎ কোনো আন্দোলন নয়। বেতন-ভাতা-মান-মর্যাদার প্রশ্নে তারা মাঠে নেমেছেন।

সমমানের কিংবা তারও নিচের শিক্ষাগত যোগ্যতায় কোনো কোনো দপ্তরের সরকারি চাকরিজীবীরা ১০ম গ্রেডে বেতন-ভাতা পাচ্ছেন। তাদের মর্যাদাও বেশি। কিন্তু বেতন-ভাতা, গ্রেড, মর্যাদায় পিছিয়ে আছেন দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা। তারা ১৩তম গ্রেডে বেতন-ভাতা পান।

সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর (এসআই), বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক বা ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা স্নাতক বা সমমানের শিক্ষাগত যোগ্যতায় ১০ম গ্রেডে বেতন-ভাতা পান। স্নাতক বা সমমানের শিক্ষাগত যোগ্যতারও নিচে এইচএসসিতে ডিপ্লোমা পাস নার্স এবং উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তার গ্রেড ১০ম।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় আন্দোলনে থাকা শিক্ষক নেতাসহ বেশকিছু শিক্ষকের বিরুদ্ধে শোকজ ও বদলিসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। তবে দাবির বিষয়ে সরকার আন্তরিক বলেও মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। সে জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে শিক্ষকদের দাবির বিষয়ে যৌক্তিকতা নিয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।

সহকারী শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের প্রাণের দাবি- ১১তম গ্রেড প্রদান, ১০ বছর ও ১৬ বছর পূর্তিতে উচ্চতর গ্রেড সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান এবং শতভাগ বিভাগীয় পদোন্নতির নিশ্চয়তা।

সহকারী শিক্ষকদের দাবি কেন যৌক্তিক?
শিক্ষকদের দীর্ঘ দিনের আন্দোলনের মধ্যে গত আগস্টে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিদ্যালয় শাখা থেকে অর্থ বিভাগে চিঠি পাঠানো হয়। সেখানে সমযোগ্যতা সম্পন্ন অন্যান্য বিভাগের ১০ম গ্রেডের চিত্র তুলে ধরা হয়। এতে দেখা যায়-

স্নাতক/সমমান শিক্ষাগত যোগ্যতায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা ১০ম গ্রেড, স্নাতক/সমমান শিক্ষাগত যোগ্যতায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাব-ইন্সপেক্টররা (এসআই) ১০ম গ্রেড, এইচএসসি (ডিপ্লোমা ইন নার্সিং) শিক্ষাগত যোগ্যতায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নার্স/সিনিয়র নার্সরা ১০ম গ্রেড, এস.এস.সি (ডিপ্লোমা-ইন-কৃষি) শিক্ষাগত যোগ্যতায় কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা ১০ম গ্রেড, স্নাতক/সমমান শিক্ষাগত যোগ্যতায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের ইউনিয়ন পরিষদের সচিবদের ১০ম (প্রস্তাবিত), স্নাতক/সমমান শিক্ষাগত যোগ্যতায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক/ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের ১০ম গ্রেড, স্নাতক সমমান (সি-ইন-এড/বিএড/ডি-ইন-এড) শিক্ষাগত যোগ্যতায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পিটিআই সংলগ্ন পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড দেওয়া হয়েছে।

একই ক্যারিকুলাম, একই সিলেবাস ও একই শিক্ষার্থী নিয়ে কাজ করা পিটিআইসংলগ্ন পরীক্ষণ বিদ্যালয়ে শিক্ষক পদে নিয়োগ যোগ্যতা: স্নাতক (দ্বিতীয় শ্রেণি), সি-ইন-এড/বি.এড/ডি-ইন-এড), বেতন গ্রেড: ১০ম হলেও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা: সি-ইন-এড/স্নাতক (২য় বিভাগ) সমমান হওয়ার পরও ১০ম গ্রেড পেতে শুধুমাত্র আমলাতান্ত্রিক প্রতিবন্ধকতা, বলছেন শিক্ষকরা।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক অর্থ বিভাগে প্রেরিত ১০ম গ্রেডের যৌক্তিকতার আলোকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের ১০ম গ্রেডের মর্যাদা ঘোষণার দাবিতে গত ৮ নভেম্বর শিক্ষকদের কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি পালিত হয়।

শিক্ষকরা বলছেন, প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগ যোগ্যতা: স্নাতক সমমান (২য় বিভাগ), বেতন গ্রেড: ১৩তম; যেখানে অষ্টম শ্রেণি পাস ড্রাইভারদের বেতন গ্রেড: ১২তম (বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন)। এছাড়া সচিবদের পাচক ভাতার চেয়ে শিক্ষার সূতিকাগারের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন কম।

২০০৬ সালে বৈষম্য শুরু, ৩ দফার পক্ষে যুক্তি:
সহকারী শিক্ষকবৃন্দ ২০০৬ সালের ২৮ আগস্ট পর্যন্ত প্রধান শিক্ষকের পরের ধাপে চাকরি করতেন। একদিন পর ২৯ আগস্ট তাদের মধ্যে দুই ধাপ বেতন বৈষম্য সৃষ্টি হলে সহকারী শিক্ষকবৃন্দ শিক্ষক সমিতি থেকে আলাদা হয়ে তাদের বেতন বৈষম্য নিরসনের আন্দোলন শুরু করেন।

২০১৪ সালের ৯ মার্চ প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন আপগ্রেড করলে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের মধ্যে তিনধাপ বেতন বৈষম্য সৃষ্টি হয়। তখন থেকে সহকারী শিক্ষক সংগঠনগুলো বেতন বৈষম্য নিরসনে আন্দোলনকর্মসূচি পালন করে আসছেন। ২০২০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি সহকারীদের বেতন বৈষম্য একধাপ কমিয়ে তাদের ১৩তম গ্রেডে বেতন স্কেল উন্নীত করা হয়, তাতে কিছুটা বৈষম্য কমলেও সহকারী শিক্ষকগণ প্রধান শিক্ষকের পরের ধাপের বেতনের জন্য আন্দোলন কর্মসূচি পালন করে চলেছেন। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় বর্তমান সরকার বৈসম্য নিরসনের সরকার হয়েও সহকারী শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষকের মধ্যে তিনধাপ বেতন বৈষম্য সৃষ্টি করছেন। ইতিমধ্যে প্রধান শিক্ষকদের ১০ম গ্রেডে বেতন নির্ধারণে সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন কিন্তু সহকারী শিক্ষকদের বেতন গ্রেড উন্নীত করনের কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি। অর্থাৎ বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক ১০ম গ্রেড ও সহকারী শিক্ষক ১৩তম গ্রেড। সহকারী শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষকের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে তিনধাপ বেতন বৈষম্য যা সহকারী শিক্ষকগণ কোন প্রকারে মেনে নিবেন না কারণ তারা প্রধান শিক্ষকের পরের ধাপে চাকরি করতেন, এখন কেন? কোন অপরাধে তারা তিনধাপ নিচের গ্রেডে চাকরি করবেন। বৈষম্য নিরসনকারী সরকারের কাছে তাদের সবিনয় অনুরোধ, প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য কমিয়ে সহকারী শিক্ষকদের ১১তম গ্রেডে বেতন নির্ধারণ করা হোক।

সহকারী শিক্ষকদের দ্বিতীয় দাবি, প্রধান শিক্ষকের শূন্য পদে শতভাগ পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ করতে হবে। কারণ যখন প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকের অনুপাত ছিলো ১:৪৩ তখন পদোন্নতি ছিলো ৬৫ শতাংশ, এখন প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকের অনুপাত ১:৪৭; কাজেই পদোন্নতি শতভাগ করতে হবে যেহেতু শতভাগ পদোন্নতি দিলেও মোট শিক্ষকের মাত্র ১৭ শতাংশ শিক্ষক পদোন্নতি পাবেন কারণ প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষক পদের অনুপাত ১:৭। ২০০৯ সাল থেকে পদোন্নতি বন্ধ ছিলো। ২০১৭-১৮ সালে সহকারী শিক্ষকদের চলতি দায়িত্বে পদোন্নতি দেওয়া হয়। তাদের স্থায়ী করার কোন ব্যবস্থা করা হয়নি। ২০২৪ সালে কয়েকটি উপজেলায় পদোন্নতি দিলেও এখনো ৩২ হাজার প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য। পদোন্নতি না পেয়ে হাজার হাজার সহকারী শিক্ষক ও চলতি দায়িত্বের প্রধান শিক্ষকগণ অবসরে চলে যাচ্ছেন। ৩০/৩৫ বছর এক পদে চাকরি করে পদোন্নতি না হলে শিক্ষকদের মনে হতাশা তৈরি হয়, ফলে পাঠদানেও তাদের অনীহা তৈরি হয়। এজন্য অবিলম্বে পদোন্নতির দাবি করা হয়।

শিক্ষকদের তৃতীয় দাবি, ১০ বছর ও ১৬ বছরের উচ্চতর গ্রেড প্রদানে উন্নীত স্কেলকে উচ্চতর গ্রেড হিসাবে বিবেচনা করে শিক্ষকদের উচ্চতর গ্রেড থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। শিক্ষকদের ২০২০ সালের ২ সেপ্টেম্বর চাকরি উচ্চতর গ্রেড প্রদানে গণনা করা হচ্ছে না, যা মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন। উন্নীত স্কেলকে উচ্চতর গ্রেড হিসাবে বিবেচনা না করে ১০ ও ১৬ বছরের উচ্চতর গ্রেড দিতে হবে।

দাবির পক্ষে আন্দোলন
৩০ আগস্ট শহীদ মিনারে বাংলাদেশ প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সংগঠন ঐক্য পরিষদের তিন দফা দাবি আদায়ের জন্য মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সহকারী শিক্ষকদের প্রধান দাবি, প্রধান শিক্ষকদের সাথে তাদের তিনধাপ বেতন বৈষম্য নিরসন করা। প্রধান উপদেষ্টার সরাসরি হস্তক্ষেপে ২৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে দাবি বাস্তবায়ন না হলে ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আমরণ অনশন।

সবশেষ আপডেট
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকবৃন্দের কয়েকটি সংগঠন ১ ডিসেম্বর থেকে কর্মবিরতি এবং পরবর্তীতে ৩ ডিসেম্বর থেকে কমপ্লিট শাট ডাউন কর্মসূচির বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় অবহিত রয়েছে।

মন্ত্রণালয় জানায়, সহকারী শিক্ষকদের ১১তম গ্রেডে বেতন প্রদানের দাবিসহ অন্য আরো দুটি দাবি, যথা ১০ ও ১৬ বছর চাকরি শেষে উচ্চতর গ্রেড প্রাপ্তির জটিলতা নিরসন এবং প্রধান শিক্ষক পদে সহকারী শিক্ষকদের মধ্য হতে শতভাগ বিভাগীয় পদোন্নতির বিষয়ে ইতোমধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। দাবিসমূহ বাস্তবায়নের বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, অর্থ উপদেষ্টা এবং বেতন-কমিশনের সভাপতির সঙ্গে উল্লিখিত দাবিসমূহ বাস্তবায়নের বিষয়ে ব্যক্তিগতভাবে আলোচনা করেছেন। এর আগে এ মন্ত্রণালয় থেকে গত ৭ আগস্ট সহকারী শিক্ষকদের বেতন স্কেল ১৩তম গ্রেড হতে ১১তম গ্রেডে উন্নীতকরণের বিষয়টি বিবেচনার জন্য জাতীয় বেতন কমিশনের সভাপতিকে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি পাঠানো হয়।

সহকারী শিক্ষকদের বেতন স্কেল উন্নীতকরণের বিষয়টি পে-কমিশনের প্রতিবেদন পাওয়ার পরপরই অর্থ বিভাগ থেকে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে মর্মে ১০ নভেম্বর অর্থ বিভাগের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়েছে।

গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, শিক্ষকদের বেতন কাঠামো নিয়ে কমিশনে আলাদা একটি প্রস্তাব আছে। তাদের জন্য আলাদা কাঠামো হলে গ্রেডের বিষয়টি আর মুখ্য থাকবে না।

ইউকে/আরএ/এএস