স্মৃতির আলোয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

বাংলা সাহিত্যের দুই জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও ইমদাদুল হক মিলন। পিঠাপিঠি জন্মদিন তাঁদের। একজনের ৭ সেপ্টেম্বর, অন্যজনের ৮ সেপ্টেম্বর। স্মৃতিগদ্য লিখেছেন কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন।

ইমদাদুল হক মিলন: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি কিন্তু ভয়াবহ নাক ডাকি। তুমি আমার সঙ্গে ঘুমাতে পারবে তো! ১৯৯৬ সালের কথা। ইলেকশন অবজারভার করতে সুনীলদার সঙ্গে আমাকে পাঠানো হয়েছে বরিশাল অঞ্চলে। আমাদের সঙ্গে এক তরুণ সরকারি কর্মকর্তা। ঢাকা থেকে গাড়ি নিয়ে রওনা দিয়েছি। মাওয়া হয়ে চলে যাব বরিশালে। মাওয়ার আগের গ্রামটি মেদিনীমণ্ডল। আমার জন্মের গ্রাম।

১২ বছর বয়স পর্যন্ত ওই গ্রামে নানির কাছে ছিলাম। ছেলেবেলা আচ্ছন্ন করে রাখা গ্রাম। সড়কের পাশেই আমার নানাবাড়ি। সেই বাড়ি বরাবর গাড়ি আসতেই সুনীলদাকে হাত তুলে দেখালাম, ওই যে সুনীলদা, ওটা আমার নানাবাড়ি। গ্রামের নামটাও বললাম।

আশ্চর্য স্মৃতিশক্তি সুনীলদার। গ্রামের নাম শুনে বললেন, মণীন্দ্র ঠাকুরের বাড়ি কোনটা?

মণীন্দ্র ঠাকুরের নাম শুনে আমি অবাক। আপনি কী করে এই নাম জানলেন?

সুনীলদা হাসলেন। তোমার একটা গল্প পড়েছিলাম। ‘জীবনযাত্রা’। সেই গল্পের মূল চরিত্র মণীন্দ্র ঠাকুর। ঠাকুরবাড়িটাও দেখালাম।

বরিশালে তেমন কোনো ভালো হোটেল তখন ছিল না। তারপরও সবচেয়ে ভালো যে হোটেল, সেখানে আমাদের তোলা হলো। পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে।

প্রথমে বরিশালের ডিসি অফিসে গেলাম। ডিসি ভদ্রলোকের ওখানে চা খেয়ে হোটেলে। আমাদের হোটেলে পৌঁছে দিয়ে তরুণ কর্মকর্তা চলে গেলেন তাঁর আত্মীয়ের বাড়িতে। সেখানেই থাকবেন। সকালবেলা আমাদের নিয়ে বেরোবেন।

কাল ইলেকশন।

রুমে ঢুকে সুনীলদা একটা হাঁফ ছাড়লেন। ব্যাগ থেকে দ্রব্য বের করে নিজেই দুটো গ্লাসে ঢাললেন। এসো, শুরু করা যাক।

দ্রব্য চলার ফাঁকেই নাক ডাকার কথাটা বললেন। আমি গায়েই মাখলাম না।

মাঝারি সাইজের একটাই ভালো রুম পাওয়া গেছে হোটেলে। দুটো সিঙ্গেল বেড পাতা। একটা উত্তর-দক্ষিণে, একটা পুবে-পশ্চিমে। সুনীলদা উত্তর-দক্ষিণের বেডে বসেছেন; অর্থাৎ এই বেডেই তিনি ঘুমাবেন। অন্যটা আমার।

পানাহার শেষ করে সাড়ে ১১টার দিকে শুয়ে পড়লাম। শোয়ার মিনিটখানেকের মধ্যে শুরু হলো সুনীলদার নাকডাকা। ক্রমে এমন অবস্থা, আমি হতভম্ব।

নেশাফেসা উধাও হয়ে গেল। একজন মানুষ শোয়ার মিনিটখানেকের মধ্যে এভাবে ঘুমিয়ে পড়তে পারে, এটা এক বিস্ময় আর হচ্ছে নাকডাকা। এ রকম শব্দে নাক ডাকেন বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি!

রাতটা যে আমার কেমন করে কাটল!

মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে পড়ি, আচমকা জেগে যাই। মনে হচ্ছে সুনীলদার নাকডাকার শব্দে আমি তো বটেই, এই হোটেলের অন্যান্য রুমের লোকজনও ঘুমাতে পারছে না।

মাঝরাতের দিকে সুনীলদার নাকডাকার শব্দটা যেন আরেকটু বাড়ল। শুনে মনে হলো, শুধু এই হোটেলের না, বোধ হয় পুরো বরিশাল শহরের ঘুম ভেঙে গেছে।

সকালবেলা কথাটা বললাম সুনীলদাকে। শুনে বললেন, টর্পেডো তো বলে, আমার নাকডাকার শব্দে নাকি পুরো জাতি জেগে যায়।

টর্পেডো মানে তারাপদ রায়। তারাপদ রায়ের টর্পেডো নামটা দিয়েছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়।

আমরা তারপর নির্বাচন ঠিকঠাক হচ্ছে কি না, দেখতে বেরিয়েছিলাম। গাবখান নামের ছোট্ট এক নদীর এপারে আওয়ামী লীগের নেতা আমির হোসেন আমুর সঙ্গে দেখা। একটা চায়ের দোকানের সামনের বেঞ্চে আমু সাহেব মাঝখানে, সুনীলদা আর আমি দুপাশে। চা খেতে খেতে কথা হলো। দুয়েকটা কেন্দ্র ঘুরে দেখার পরেই সুনীলদা বললেন, অনেক হয়েছে। চলো, এবার ধানসিঁড়ি নদীটা দেখে আসি।

নদীর প্রতি আশ্চর্য এক টান ছিল সুনীলদার। তাঁর কবিতায় আছে, ‘নদীটির স্বাস্থ্য ছিল ভালো/হঠাৎ বনের পাশে সে আমাকে/ একটুখানি চমকে দেয়’।
বন-পাহাড় আর পৃথিবী চষে বেড়ানো মানুষ সুনীলদা। একবার এক পাহাড়ি নদী দেখে এতটাই উত্তেজিত হয়েছিলেন, সেই নদীতে নেমে সাঁতার কাটতে কাটতে তাঁর মনে হয়েছিল তিনি যেন রমণসুখ অনুভব করছেন।

ধানসিঁড়ি জীবনানন্দের নদী। বরিশালে এসে এই নদী না দেখে তিনি কি পারেন?

আশ্চর্য ব্যাপার। ধানসিঁড়ির সন্ধান কেউ আমাদের দিতে পারছিল না। এলাকার কেউ নদীটা চেনেই না।

শেষ পর্যন্ত এক যুবক ধানসিঁড়ির কাছে নিয়ে এল আমাদের। দুটো বসতবাড়ির মাঝখান দিয়ে নদীতীরে এলাম আমরা। সেখানে পুরোনো পাকা ঘাটলা। একটা ছইঅলা নৌকা বাঁধা আছে। খালি গায়ের মাঝি উদাস ভঙ্গিতে বসে বিড়ি টানছে। হাফপ্যান্ট পরা একটি কিশোর ছেলে আছে সঙ্গে। রোগা পটকা, রোদে পোড়া শরীর। ছেলেটিকে দেখে আমার মনে পড়ল সুনীলদার কবিতার লাইন,

‘নবীন কিশোর, তোমায় দিলাম
ভুবনডাঙার মাঠ!’

সেই নৌকা ভাড়া করে আমরা ধানসিঁড়ি দেখতে বেরোলাম। খালের মতো চিরল নদী। এপারে মানুষের বসতি, ওপারে বাবলাগাছের বন। মাঝিটি গ্রাম্য কুসংস্কারে বিশ্বাসী। আমরা তাকিয়ে তাকিয়ে নদী দেখছি, বাবলাগাছগুলো দেখিয়ে সে বলল, খুব গরম গাছ।

গাছ কী করে গরম হয় বুঝতে পারলাম না। দুজনেই তাকালাম তার মুখের দিকে।

বিড়ি খাওয়া কালো ঠোঁট মেলে হাসল মাঝি। রাইত-বিরাইতে এই দিকটায় চলাফিরা ঠিক না আরকি!

বুঝলাম তেনাদের কথা বলতে চাইছে। কিন্তু ওসবে আমাদের মন নেই। আমরা মুগ্ধ চোখে দেখছি জীবনানন্দের ধানসিঁড়ি। সুনীলদার মধ্যে কী রকম যেন একটা ঘোর তৈরি হয়েছে। আমি আগেও লক্ষ করেছি অনেকের মধ্যে থেকেও, তুমুল হইহল্লা আর আড্ডার মধ্যে থেকেও সুনীলদা কোন ফাঁকে যেন আলাদা হয়ে যান। কোন ফাঁকে যেন চলে যান নিজের তৈরি করা ভুবনে। চারপাশে সবাই আছে, তিনি থেকেও নেই। কোথায় যেন হারিয়ে গেছেন।

নৌকায় বসেই ঠিক করলাম ঢাকায় ফিরে এই ভ্রমণ নিয়ে একটা লেখা লিখব। সুনীলদার কবিতার লাইন হবে লেখার শিরোনাম। ‘বিষণ্ন আলোয় এই বাংলাদেশ’। সেই লেখা আর লেখা হলো না। সুনীলদা ঠিকই কলকাতায় ফিরে ‘দেশ’ পত্রিকায় লিখলেন ‘ধানসিঁড়ি নদীর সন্ধানে’। সেই লেখার সঙ্গে আরও কিছু লেখা একত্র করে ‘আনন্দ’ থেকে বই বেরোল। ‘ধানসিঁড়ি নদীর সন্ধানে ও অন্যান্য’।

দুপুরের দিকে রওনা দিয়েছিলাম ভান্ডারিয়ার দিকে। সঙ্গে গাড়ি আর সেই তরুণ কর্মকর্তা। ভান্ডারিয়া আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নির্বাচনী এলাকা। তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার ছেলে। ইত্তেফাকের সম্পাদক। সুনীলদা বেশ উৎসাহ দেখালেন তাঁর এলাকায় যেতে।

ভান্ডারিয়া এলাকার একটা ভোটকেন্দ্রে ঘোরার সময় সুনীলদা আমাদের সঙ্গের তরুণ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করলেন, এখান থেকে চাখার কত দূর? শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক সাহেবের বাড়িটা একটু দেখতে চাই। এলাকাটা দেখতে চাই।

ওই তরুণ কর্মকর্তাও আমাদের মতোই উৎসাহী। বললেন, চলুন।

আমরা চাখারের দিকে রওনা দিলাম।

চাখার ভান্ডারিয়ার মতো উন্নত এলাকা নয়। সবকিছু ঘুরে ঘুরে দেখলাম। শেরেবাংলার বাড়িতে ঢুকলাম। পুরোনো আমলের বনেদি দালানবাড়ি। লালচে রঙের।

সামনের দিককার লম্বা মতন একটা রুমে শেরেবাংলার ব্যবহারের জিনিসপত্র ইত্যাদি নিয়ে একটা মিউজিয়াম। মিউজিয়াম ঘুরে ঘুরে দেখছি। পুরোনো টেবিলের ওপর বিশাল আকৃতির, মোটা কাচের সবুজাভ একটা গ্লাস। এ রকম গ্লাস আমি আমার নানাবাড়িতে দেখেছি। কিন্তু এত বড় দেখিনি। গ্লাসের গায়ে একটা কাগজ সাঁটা। গোটা গোটা হাতে লেখা, ‘এই গ্লাসে শেরেবাংলা ইসবগুলের শরবত খেতেন’।

শেরেবাংলা বিশালদেহী মানুষ ছিলেন। তাঁর খাওয়া-দাওয়ার নানা রকমের কাহিনি আমরা শুনেছি। চল্লিশটা ফজলি আম নাকি এক বসায় খেতে পারতেন।

অবিভক্ত বাংলার এই অবিসংবাদিত নেতার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আবার বরিশালে। ততক্ষণে বরিশালে রটে গেছে এই শহরে এসেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।

পরদিন সকালবেলা দলে দলে লোকজন আসতে লাগল। নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর। অনেকের হাতেই সুনীলদার বই। তারা অটোগ্রাফ নেবে। শিশু-কিশোরদের হাতে ‘কাকাবাবু’ সিরিজের বই। ভালো রকম একটা ভিড় লেগে গেল হোটেলে। আমাদের রুমে জায়গায়ই হয় না। অনেকে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।

সাংবাদিক নেতারা এলেন। প্রেসক্লাবে একবার যেতেই হবে। সেদিনই ফেরার কথা আমাদের। কিন্তু অবস্থা এমন দাঁড়াল, ফেরার পথ বন্ধ। অন্তত একটা দিন বরিশালবাসীকে দিতেই হবে।

সেই দিনটা আমরা রয়ে গেলাম।

এক ফাঁকে বরিশাল শহরে জীবনানন্দ দাশের বাড়িটি দেখা হলো। বিকেলে প্রেসক্লাবে জমল ভালোরকমের আড্ডা। ঘন দুধের চা আর শিঙাড়া। সাংবাদিকদের সঙ্গে আছেন শহরের শ্রদ্ধেয়জনেরা। সুনীলদার পাঠক সবাই। গল্পে আড্ডায় অনেকটা রাত হলো। চমৎকার কাটল সময়টা।

পরদিন সকালে ঢাকার পথে রওনা।

গাড়িতে সুনীলদার গল্প, উপন্যাস, কবিতা, ভ্রমণকাহিনি আর ছোটদের লেখা নিয়ে অনেক রকমের কথা হলো। আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করছিলাম, তিনি তাঁর মতো করে বলে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ একটা কবিতার কথা মনে এল আমার।

‘মহারাজ, আমি তোমার সেই পুরোনো বালকভৃত্য/ মহারাজ, মনে পড়ে না?’

আমি কবিতার অতি নগণ্য একজন পাঠক। কিন্তু কোনো কোনো কবিতার ভেতরকার রহস্য বুঝে উঠতে পারি না। তাৎপর্য বুঝে উঠতে পারি না। সুনীলদার এ কবিতাটি তেমন এক কবিতা।

কথাটা বললাম সুনীলদাকে। তিনি হাসিমুখে আমার দিকে তাকালেন। কবিতাটির আসলে কোনো অর্থ নেই। কোনো কোনো অর্থহীন কবিতাও লেখা হয়।

বাক্যের পর বাক্য সাজিয়ে, সুন্দর সুন্দর শব্দ বসিয়ে অর্থহীন কবিতাও কবিরা লেখেন।

শুনে বিস্মিত হয়েছিলাম।

ঢাকায় সুনীলদার থাকার ব্যবস্থা ছিল শেরাটন হোটেলে। সন্ধ্যাবেলা শেরাটনের গেট দিয়ে যখন গাড়ি ঢুকছে, সুনীলদা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, একটা অধ্যায় শেষ হলো।

প্রিয় সুনীলদা, আপনার জীবনের কোনো অধ্যায় কি আসলে শেষ হয়েছে! বাংলা সাহিত্যের সব অধ্যায়েই তো রয়ে গেছেন আপনি। ‘কাকাবাবু’ সিরিজের এক লেখায় আপনি লিখেছিলেন, ‘আকাশ কখনও পুরনো হয় না। আকাশ প্রতিদিন নতুন।’ বাংলা সাহিত্যের এক আকাশ আপনি। আপনার কোনো শেষ নেই।

আপনি প্রতিদিন নতুন।

ইউকে/এইচএস