বোতল আর সিগারেট ফিল্টারে শিল্পকর্ম!

বার্তাকক্ষ প্রতিবেদন: মাঠের মাঝে একা দাঁড়িয়ে বিশাল একটি গাছ। আছে শেকড়, কাণ্ড, ডাল; নেই শুধু পাতা।

সেই গাছকে ঘিরে বিশাল আকৃতির মাছ, কচ্ছপ, গ্রেনেড, মানুষের মস্তিষ্ক ও গাছের গুড়ি। তবে এর কিছুই জীবন্ত নয়।

সবকিছুই তৈরি করা হয়েছে ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের বোতল, চিপসের প্যাকেট ও সিগারেটের ফিল্টার দিয়ে।

প্লাস্টিকের ক্ষতিকর দিক ও জীববৈচিত্র্যে এর প্রভাব সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতেই এমন অভিনব প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘বিডি ক্লিন’।

রাজধানীর মহাখালী টিঅ্যান্ডটি মাঠে আয়োজন করা এই প্রদর্শনীর প্রতিকৃতিগুলো তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে ৩০ টন বোতল, তিন কোটি সিগারেটের ফিল্টার ও ৬ টন চিপসের প্যাকেট।

এই প্রদর্শনীতে গাছ, মাছ, কচ্ছপ, মস্তিষ্ক, গ্রেনেড ছাড়াও দেখা যাবে বোতল দিয়ে তৈরি করা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুটি প্রতিকৃতি। প্রদর্শনীর স্টেজ ও সীমানা প্রাচীর তৈরি করা হয়েছে ফেলে দেওয়া বোতল ও চিপসের প্যাকেট দিয়ে।

৩০ ডিসেম্বর সকালে এই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম। ব্যতিক্রমী এই প্রদর্শনী দেখে মুগ্ধ হয়ে সেদিনই আয়োজক সংগঠনকে ১০ লাখ টাকার অনুদান দেন তিনি। আগামী ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত চলবে এই প্রদর্শনী। কোনো প্রবেশমূল্য ছাড়াই প্রতিদিন বেলা ১১টা থেকে রাত ১০টা এই প্রদর্শনী উপভোগ করতে পারবেন দর্শনার্থীরা।

আয়োজকরা জানান, মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে এই প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। প্রায় একমাস ধরে বিডি ক্লিনের ৪০ হাজার সদস্য ফেলে দেওয়া বোতল, চিপসের প্যাকেট ও সিগারেটের ফিল্টার সংগ্রহ করেছেন। আর প্রদর্শনীতে থাকা এসব প্রতিকৃতি তৈরিতে দিনরাত কাজ করেছে সংগঠনটির পাঁচ শতাধিক সদস্য।

মহান মুক্তিযুদ্ধে নিহত ৩০ লাখ শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই প্রদর্শনীতে থাকা শিল্পকর্মগুলো তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে ৩০ টন প্লাস্টিক বোতল, সংখ্যায় যা ৪৫ লাখের বেশি। চিপসের প্যাকেট লেগেছে ছয় টন ও সিগারেটের ফিল্টার লেগেছে পাঁচ হাজার কেজি। প্রতি কেজিতে ছয়-সাট হাজার সিগারেট ফিল্টার হিসেবে মোট ফিল্টার লেগেছে তিন কোটির বেশি।

তৃতীয়বারের মতো আয়োজিত এই প্রদর্শনীর এবারের প্রতিপাদ্য ছিল ‘সেভ আর্থ, সেভ বাংলাদেশ’। আর স্লোগান ছিল- ‘প্লাস্টিক সামগ্রী ব্যবহারে না তো বলছি না, বলছি শুধু হতে সচেতন, চলুন সবাই মিলে গড়ি পরিচ্ছন্ন বাংলাদেশ, করে অতীব যতন’।

প্রদর্শনীতে যা যা আছে : প্রদর্শনীতে ঢুকতেই প্রথমে চোখে পড়বে প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে তৈরি গেট। দর্শনার্থীদের প্রবেশের জন্য এমন গেট তৈরি করা হয়েছে দুটি। গেইট দিয়ে প্রবেশের পর হাতে ডানে প্রথমেই চোখে পড়বে রং-বেরঙের বোতল দিয়ে তৈরি বিশাল আকারের মাছের প্রতিকৃতি। তার পাশেই কচ্ছপের প্রতিকৃতি। মাঠের মাঝখানে রয়েছে পাতাহীন একটি গাছের প্রতিকৃতি। যার পুরোটাই তৈরি করা হয়েছে সিগারেটের ফিল্টার দিয়ে।

গাছের পেছনে রয়েছে বিশাল আকৃতির একটি সিগারেটের ফিল্টার। এই ফিল্টারও তৈরি করা হয়েছে ফেলে দেওয়া সিগারেটের ফিল্টার দিয়ে। মাঠের বাঁ পাশে রয়েছে একটি বিশাল আকৃতির গ্রেনেডের প্রতিকৃতি। তার পাশে মানুষের মগজের প্রতিকৃতি। দুটোই তৈরি করা হয়েছে বোতল ও চিপসের প্যাকেট দিয়ে।

মাঠের মাঝ বরাবর এক পাশে রয়েছে বড় প্লাস্টিকের বোতলের আদলে তৈরি স্টেজ। এই স্টেজের নিচে গাছের গুড়ির প্রতিকৃতি। মাঠের এক পাশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি সংবলিত ছবি। প্লাস্টিক বোতলে তৈরি সেই প্রতিকৃতিতে লেখা-বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া প্রিয় বাংলাদেশ/ আমরা রাখবো পরিষ্কার/ মহান বিজয়ের মাসে/ এ আমাদের অঙ্গীকার।

মাঠের অন্য পাশে রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি সংবলিত আরেকটি প্রতিকৃতি। সেখানেও লেখা- শেখ হাসিনার উন্নয়নের প্রিয় বাংলাদেশ/ আমরা রাখবো পরিষ্কার/ মহান বিজয়ের মাসে/ এ আমাদের অঙ্গীকার। এ ছাড়া পুরো প্রদর্শনীর প্রাচীর তৈরি করা হয়েছে প্লাস্টিক বোতল দিয়ে।

এসব শিল্পকর্মের প্রতিটি তৈরির পেছনে ব্যাখ্যা রয়েছে আয়োজকদের। বিডি ক্লিনের প্রতিষ্ঠাতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ফরিদ উদ্দিন বলেন, কেউ হয়তো ব্যবহারের পর একটি বোতল ফেলেছে। যখন এমন লাখো বোতল একসঙ্গে হচ্ছে, তখন তা বড় আকার ধারণ করছে। এই বড় ব্যাপারটি বোঝাতে আমরা বিশাল বোতলের আদলে আমাদের স্টেজ তৈরি করেছি। যার নিচে সিগারেটের ফিল্টার দিয়ে গাছের গুড়ির প্রতিকৃতি করা হয়েছে।

মাছ ও কচ্ছপ তৈরির ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, প্লাস্টিক এবং সিগারেটের ফিল্টারের মধ্যে যে রাসায়নিক রয়েছে, তাতে জলরাশি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, দূষিত হচ্ছে। যে দূষণ মাছ এবং মাছের প্রজনন ক্ষমতা ধ্বংস করে দিচ্ছে। তাই মাছ তৈরি করা হয়েছে। একই কারণে ধ্বংস হচ্ছে সমুদ্রের ভারসাম্য রক্ষা করা সামুদ্রিক প্রাণীরা। তারই প্রতীক হিসেবে কচ্ছপের প্রতিকৃতি তৈরি করা হয়েছে।

সিগারেটের ফিল্টার তৈরির ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, সিগারেটের ফিল্টারের প্রতিকৃতিতে লেখা আছে, আমি ধূমপান পরবর্তী পরিত্যক্ত সিগারেট ফিল্টার, আমি সাইলেন্ট কিলার । এ কারণে এটাকে একটু আড়ালেও রাখা হয়েছে। যদিও সবার চোখের সামনে এটি ক্ষতি করছে, কিন্তু এত বড় মারাত্মক দূষণকারী পদার্থ আমাদের নজরেই আসছে না। এ কারণে বিশাল আকৃতির একটি সিগারেটের ফিল্টার রাখা হয়েছে।

মানুষের মগজ তৈরির ব্যাখ্যায় ফরিদ উদ্দিন বলেন, কিছুদিন আগে পত্র-পত্রিকায় লেখা এসেছে, মানুষের মগজে প্লাস্টিকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এটা এমনি এমনি মগজে স্থাপিত হয়নি। আমরা দৈনন্দিন যে খাবার গ্রহণ করছি, সেই খাবারের মধ্যে প্লাস্টিকের যে রাসায়নিকগুলো রয়েছে, সেগুলোই হয়তো মস্তিস্কে গিয়ে প্রতিফলিত হচ্ছে। আমরা আমাদের মগজটাকে ধ্বংস করছি, নিস্তেজ করে দিচ্ছি। পক্ষান্তরে আমরা নিজেরাই নিজেদের ক্ষতি করছি। তা বোঝাতেই এই মগজের প্রতিকৃতিটা করা হয়েছে।

গ্রেনেড তৈরির ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, প্লাস্টিক সামগ্রী যদি ফেলে দেওয়া হয়, তা আমাদের জন্যই হুমকিস্বরূপ হয়ে মারাত্মক অস্ত্র হিসেবে ফিরে আসবে। যেটা আমাদেরকে ধ্বংস করে দিতে পারে। যে কারণে গ্রেনেডের প্রতিকৃতি করা হয়েছে। আমরা যে প্লাস্টিকের বোতল ফেলে দিচ্ছি, সেটাই আমাদের জন্য গ্রেনেডের মতো ভয়ঙ্কর হয়ে ফিরে আসবে।

গাছের প্রতিকৃতির তৈরির ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, গাছ হলো আমাদের অক্সিজেন হাব। কিন্তু প্লাস্টিক, সিগারেটের ফিল্টারের রাসায়নিকের কারণে মাটি এমনভাবে দূষিত হচ্ছে, যে গাছ আর মাটি থেকে রস শোষণ করতে পারছে না। যা শোষণ করছে সবই রাসায়নিক। এই রাসায়নিক শোষণের ফলে গাছগুলো পাতাবিহীন হয়ে যাচ্ছে। তারই প্রতীক হিসেবে এই গাছের প্রতিকৃতি তৈরি করা হয়েছে।

পাতাহীন এই গাছের সামনে দাঁড়ালে পেছনে গাছের দুই পাশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুটি প্রতিকৃতি দেখা যাবে। দেখে মনে হবে বঙ্গবন্ধু ও তার কন্যা বিমর্ষ নয়নে গাছের পানে তাকিয়ে আছেন।

এই বিষয়ে ফরিদ উদ্দিন বলেন, এই গাছটি বাংলাদেশের একটি প্রতীক। এই গাছ দিয়ে আমরা আমাদের সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশকে বুঝিয়েছি। বঙ্গবন্ধু নিজ হাতে গড়ে গিয়েছেন এই বাংলাদেশ, আর প্রধানমন্ত্রী নিজ হাতে এই দেশটার জন্য উন্নয়ন কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু যে বাংলাদেশ তারা চেয়েছেন, তা কী তারা পেয়েছেন? তাই তাদের এই বিমর্ষ চাহনির প্রতিকৃতি তৈরি করা হয়েছে।

এই প্রদর্শনীর উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে বিডি ক্লিনের এই প্রতিষ্ঠাতা বলেন, আমরা বিশ্বাস করি, প্লাস্টিক বর্জ্য যত্রতত্র না ফেললে এই মাটির দূষণ রক্ষা করা সম্ভব। সাধারণ মানুষের মাঝে এই উপলব্ধি জাগ্রত করতেই আমাদের এই প্রয়াস।

কী বলছেন দর্শনার্থীরা 

ব্যতিক্রমী এই প্রদর্শনী দেখতে প্রতিদিন সকাল থেকেই দর্শনার্থীদের ভিড় দেখা যায়। বড়দের পাশাপাশি স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরাও আনন্দের সঙ্গে এই প্রদর্শনী দেখতে আসে। বৃহস্পতিবার (৫ জানুয়ারি) তেমনি সহপাঠীদের নিয়ে প্রদর্শনীতে ঘুরতে এসেছিল টি অ্যান্ড টি গার্লস স্কুলের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী প্রত্যাশা। সে বলে, আমরা যদি বাংলাদেশকে নোংরা করতে থাকি তাহলে একদিন পৃথিবী প্লাস্টিকের রাজ্যে পরিণত হবে। এখানে প্লাস্টিক ব্যবহারে মানুষকে সচেতন করার এই উদ্যোগ দেখে ভালো লাগছে।

ইউকে/এএস