দেনমোহর শুধু পাঁচটি গাছ, প্রশংসায় ভাসছেন নবদম্পতি

নাটোর সংবাদদাতা: নিরাপত্তা এবং সামাজিক মর্যাদার অজুহাতে বিয়েতে দেনমোহর নির্ধারণ নিয়ে একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলে। দেনমোহরের পরিমাণ নির্ধারণ নিয়ে সংঘর্ষ, এমনকি শেষ মুহূর্তে বিয়ে ভেঙে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে। কিন্তু ব্যক্তিক্রম এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন এক নবদম্পতি। দেনমোহর নির্ধারণ করা হয়েছে পাঁচটি গাছের চারা। চারাগুলো আবার কনের বাবার বাড়িতেই রোপণ করা হয়েছে।

এমন একটি দৃষ্টান্তের জন্য প্রশংসায় ভাসছেন নাটোরের কনে সুকৃতি আদিত্য ও বর কুমিল্লার নাবিন আদনান দম্পতি। গত শুক্রবার নাটোরের দিঘাপতিয়া এলাকায় উত্তরা গণভবনের পাশে সুকৃতি আদিত্যের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়।

এলাকাবাসী জানান, বিয়ের দিন সুকৃতিদের বাড়ি আত্মীয়স্বজনের উপস্থিতিতে সরগরম ছিল। বর-কনে পূর্বপরিচিত। দুই পরিবারের সম্মতিতে অনেকটা ঘরোয়া পরিবেশেই বিয়ে সম্পন্ন হয় সুকৃতি আদিত্য-নাবিন আদনানের। ইসলামি রীতি অনুযায়ী বিয়ে পড়ানো হলেও দেনমোহর নির্ধারণ করা হয় গাছ। সুকৃতি ও তাঁর বাবা-মায়ের ইচ্ছাতেই মোহরানা হিসেবে বেছে নেওয়া হয় গাছ। বিয়ের আসরেই মোহরানা আদায় করে বরপক্ষ। পাঁচটি ফলদ ও বনজ গাছ হস্তান্তর করা হয়। বিয়ে পড়ানোর পরপরই বর-কনে বাড়ির আঙিনায় গাছের চারাগুলো রোপণ করেন।

বিষয়টি অবশ্য পূর্বপরিকল্পিত না হওয়ায় বরযাত্রী, আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশী প্রথমে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। পরে সবাই নবদম্পতিকে প্রশংসায় ভাসিয়েছেন। আমন্ত্রিতরা বলেন, এমন বিয়ে কখনো কেউ দেখেননি।

স্থানীয় বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তার বলেন, জীবনে এমন বিয়ে দেখেননি। বিয়েবাড়িতে এসে বর-কনের গাছ লাগানো দেখে তাঁর খুবই ভালো লেগেছে। নতুন দম্পতি সুখে-শান্তিতে থাকুক, সেই দোয়া করেন তিনি।

কনের নিকটাত্মীয় সংস্কৃতিকর্মী সৈয়দ মাসুম রেজা বলেন, ‘সব সময় কনের বা কনেপক্ষের দিকে থেকে দেনমোহরের টাকার অঙ্ক বাড়াতে দেখেছি। কিন্তু সুকৃতির বিয়েতে ব্যতিক্রম দেখলাম। তার চিন্তা-চেতনা অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়া যোগ্য।’

নাটোরের দিঘাপতিয়া এলাকার বাসিন্দা লিটন-সুস্মিতা দম্পতির একমাত্র কন্যা সুকৃতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের প্রাচ্যকলা বিভাগ থেকে মাস্টার্স এবং বর কুমিল্লার বাসিন্দা নাবিন আদনান একই অনুষদের অঙ্কন ও চিত্রায়ণ বিভাগ থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন। নাবিন এখন ঢাকায় একটি প্রতিষ্ঠানের শিল্পনির্দেশক হিসেবে কাজ করছেন। বছর ছয়েক আগে তাঁদের পরিচয়, এরপর তাঁরা পরস্পরকে ভালোবেসে ফেলেন।

কনে সুকৃতি আদিত্য বলেন, ‘বর্তমানে প্রায় প্রতিটি বিয়েতেই দেনমোহর নিয়ে যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে, আমার মনে হয় তা থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। কারণ, বিয়ে মানেই আর্থিক লেনদেনটা মুখ্য নয়। দুটি মানুষের মনের মিল হওয়াটাই বড় বিষয়। সেখান থেকে মনে হলো যে যদি এমন কিছু করা যায়, যা আমাদের প্রকৃতিকেও সুস্থ রাখবে। সেই সাথে আমাদের সম্পর্কটাও সুস্থ রাখবে। তাই নতুন জীবন শুরু করার আগে আমার মনে হয়েছে, গাছ একটা দারুণ উপকরণ হতে পারে, যেটার মাধ্যমে পরিবেশটাও সুস্থ থাকল এবং পরিবেশের সুস্থতা দেখে আমরাও খুশি থাকলাম।’

বর নাবিন আদনান বলেন, ‘দেনমোহরের বিষয়টা হচ্ছে নিরাপত্তা। আমার কাছে মনে হয়েছে, আমাদের নিরাপত্তার চাইতে পরিবেশের নিরাপত্তা বেশি জরুরি। এটা একটা প্রতীকী ব্যাপার। এর বাইরে বিশেষ কিছু নয়। প্রতীকী ব্যাপার হিসেবেই আমরা চর্চা করলাম, যাতে আমরা পরিবেশ, প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে থাকতে পারি। সুকৃতির ভিন্ন চিন্তাকে স্যালুট জানাই।’

শিশুদের জন্য জনপ্রিয় টিভি অনুষ্ঠান সিসেমি স্ট্রিট-এর বাংলাদেশি সংস্করণ সিসিমপুরের প্রধান লেখক অঙ্কনশিল্পী এম. আসলাম লিটন কনের বাবা। তিনি বলেন, ‘দেনমোহরের নামে সমাজে যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে, সেই জায়গায় মেয়ে সুকৃতি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সে জন্য বাবা হিসেবে গর্বিত।’ মেয়েকে তিনি সাধুবাদ জানান এবং মেয়ের এই সিদ্ধান্ত নতুন প্রজন্মের কাছে অনুকরণীয় হবে বলে বিশ্বাস করেন।

আসলাম লিটন বলেন, মেয়ে সুকৃতি আদিত্য সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, বিয়েতে মোহরানা নেবেন না। নিলেও একটা টোকেন নিতে চান। অভিভাবক হিসেবে তাঁরা সুকৃতির সেই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন।

ইউকে/এএস