কম টিকার খেসারত দিচ্ছে রাজশাহী!

বিশেষ প্রতিবেদক: করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর ‘লকডাউনে’র পাশাপাশি সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং গণটিকা নিশ্চিতের ওপর জোর দিয়েছেন- রাজশাহীর জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন- করোনা টিকা পাওয়ায় অনেক পিছিয়ে রয়েছে রাজশাহী।

যার খেসারত দিচ্ছে ভারত সীমান্তবর্তী এই জেলা। মঙ্গলবার (২৯ জুন) দেখেছে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ডও। এই অবস্থায় সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষকে টিকার আওতায় না আনা গেলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা শতকরা ৭০ শতাংশ করোনা রোগীই গ্রামের। স্বাস্থ্যবিধির কোনো তোয়াক্কা না করা এবং ভ্যাকসিন নেওয়ার ব্যাপারে পিছিয়ে থাকার কারণেই এখন গ্রামে করোনা রোগীর সংখ্যা বেশি।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে করোনা উপসর্গ ও আক্রান্ত নিয়ে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা প্রতিদিনই আগের রেকর্ড ভাঙছে। আর পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। এক হাজার ২৫০ শয্যার এই হাসপাতালে জনবল রয়েছে মাত্র সাড়ে ৫০০ শয্যা পরিচালনার। এরপরও বাড়তি রোগীর চাপ সামলাতে এক এক করে হাসপাতালের ৫৭টি সাধারণ ওয়ার্ড থেকে এখন পর্যন্ত ১৩টি ওয়ার্ড করোনা ইউনিটে সংযুক্ত করা হয়েছে। সর্বশেষ গত ২৭ জুন রামেক হাসপাতালের ১৪ নম্বর ওয়ার্ড করোনা ওয়ার্ডে রূপান্তর করা হয়েছে। হাসপাতালের ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন যুক্ত করে এই ওয়ার্ডেও এখন করোনা রোগী ভর্তি করা হচ্ছে। এই ওয়ার্ডের শয্যা সংখ্যা রয়েছে ৪৮টি।

আগে হাসপাতালের করোনা ইউনিটে ডেডিকেটেড শয্যা সংখ্যা ছিল ৩৫৭টি। এর সঙ্গে ৪৮টি শয্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০৫টি। এরপরও ধারণ ক্ষমতার বেশি রোগী ভর্তি রয়েছেন। ৪০৫ জনকে বেড দেওয়া গেলেও বাকিরা মেঝেতে এবং ওয়ার্ডের বারান্দায় থেকে কোনোভাবে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

বর্তমানে রামেক হাসপাতালে ৪ নম্বর ওয়ার্ডটিতে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন সংযোজনের কাজ চলছে। এখানে ৪৫টি শয্যা রয়েছে। এটি হবে করোনা ইউনিটের সর্বশেষ সংযোজন। কারণ এরপর রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আর কোনো ওয়ার্ড নতুন করে করোনা ইউনিটে সংযুক্ত করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

বর্তমানে হৃদরোগ, লিভার, কিডনি ও জরুরি প্রসূতি রোগী ছাড়া রামেক হাসপাতালে সাধারণ ওয়ার্ডে কোনো রোগী ভর্তি রাখা হচ্ছে না। এছাড়া অন্যান্য সাধারণ রোগের রোগীদের চিকিৎসা দিয়েই ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে করোনাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আক্রান্ত রোগীদের বাঁচিয়ে রাখার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন- হাসপাতালের ২৫২ জন চিকিৎসক, ৫৮০ জন নার্স ও ১৫২ জন চিকিৎসাকর্মী।

রামেক হাসপাতালের সূত্রে জানা যায়, গত বছর করোনার প্রথম ঢেউ চলাকালে ভ্যাকসিন নেওয়ার আগে এই হাসপাতালের ১২০ জন চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। এছাড়া ২৬৭ জন নার্স এবং ১০১ জন চিকিৎসাকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়ে ছিলেন।

চলতি বছর করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলা করতে গিয়ে করোনার দুই ডোজ ভ্যাকসিন নেওয়ার পর এখন পর্যন্ত মাত্র তিনজন চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এছাড়া ৫৭ জন নার্স ও ৬ জন চিকিৎসাকর্মী করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। তাই যারা করোনা টিকা নিয়েছেন তাদের করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার অনেক কম। আক্রান্ত হলেও তাদের কাউকে হাসপাতালে ভর্তি বা অক্সিজেন সাপোর্ট দেওয়ার প্রয়োজন পড়েনি।

রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন, ‘এরই মধ্যে যারা দুই ডোজ টিকা নিয়েছেন তাদের মধ্যে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার খুবই কম। মানে নেই বললেই চলে। কারণ এমন ব্যক্তি করোনা আক্রান্ত হলেও সিরিয়াস হওয়ার প্রবণতা কম। ’

এদিকে, গত বছর করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময় ভারত থেকে সেরাম ইনস্টিটিউটের অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা আসে বাংলাদেশ। বিভাগীয় শহর ও ভারত সমান্তবর্তী জেলা হওয়া সত্ত্বেও ওই টিকা থেকে সবচেয়ে কম বরাদ্দ পায় রাজশাহী। এখন করোনার ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের দ্বিতীয় ঢেউয়ে রাজশাহীকে তার মাশুল গুনতে হচ্ছে।

এরই মধ্যে যারা সেরাম ইনস্টিটিউটের অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার দুই ডোজ টিকা নিয়েছেন তারা বেশিরভাগই ভালো আছেন। কেউ কেউ দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার পর সংক্রমিত হলেও খুব বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েননি। বাড়িতে আইসোলেশনে থেকেই করোনামুক্ত হচ্ছেন তারা। কারও হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার মত সংকট তৈরি হচ্ছে না। দুই ডোজ টিকা নেওয়ার পর এখন পর্যন্ত রাজশাহী জেলায় কেবল একজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তার নাম গোলাম মোস্তফা। তার বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর। তিনি রাজশাহীর গোদাগাড়ীর উপজেলার অধিবাসী ছিলেন। তবে টিকা নেওয়া মোস্তফার মৃত্যুর কোনো তথ্য এখন পর্যন্ত রাজশাহীর সিভিল সার্জন কার্যালয়ের কাছে নেই।

রাজশাহীর সিভিল সার্জনের কার্যালয় সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী- প্রথম দফায় রাজশাহী জেলায় সেরাম ইনস্টিটিউটের অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা এসেছিল ১ লাখ ৮০ হাজার ডোজ। এর বিপরীতে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৭৭৪ জন মানুষ প্রথম ডোজ টিকা গ্রহণ করেন। স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে বেঁধে দেওয়া নির্দিষ্ট সময় পর প্রথম ডোজ টিকা গ্রহীতার মধ্যে ৮১ হাজার ৬৪০ জন মানুষ দ্বিতীয় ডোজ টিকা পেয়েছেন। এরপর মজুদ ফুরিয়ে যাওয়ায় ৫২ হাজার ১৩৪ মানুষ আর সেরাম ইনস্টিটিউটের দ্বিতীয় ডোজের টিকা পায়নি। এমন এক অনিশ্চয়তার মুখে গত ১৯ মে রাজশাহীতে গণটিকা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এই হিসেবে জেলায় মাত্র ২ দশমিক ৭৩ শতাংশ মানুষকেই টিকার আওতায় আনা গেছে। এছাড়া সীমান্তবর্তী অপর দুই জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে শূন্য দশমিক ৯৯ শতাংশ এবং নওগাঁয় ২ শতাংশ মানুষ করোনা টিকা পেয়েছে। কিন্তু রাজশাহী বিভাগের অন্য পাঁচ জেলায় টিকা প্রাপ্তির হার এক শতাংশেরও নিচে।

জানতে চাইলে রাজশাহী জেলা সিভিল সার্জন ডা. কাইয়ুম তালুকদার বলেন, সেরাম ইনস্টিটিউটের অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ডোজের টিকার বাকি অংশ এখনও আমরা পাইনি। এই কারণে যারা প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছিলেন তাদের আমরা দ্বিতীয় ডোজ টিকা দিতে পারছি না। তবে আশা করছি শিগগিরই আমাদের এই সমস্যাটার সমাধান হবে। রাজশাহীতে এরইমধ্যে ১৯ জুন থেকে দ্বিতীয় দফায় ভ্যাকসিন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। উপহার হিসেবে আসা চীনের (সিনোফার্ম) টিকা এখন শিক্ষার্থীরা পাচ্ছেন। রাজশাহী জেলার জন্য ৩১ হাজার ২০০ ডোজ টিকা এসেছে। তবে মেডিক্যাল শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আরও বেশ কয়েকটি ক্যাটাগরির মানুষ চীনের পাঠানো সিনোফার্মের এই ভ্যাকসিন পাবেন।

এর মধ্যে ডেন্টাল কলেজ, নার্সিং কলেজ, মেডিক্যাল টেকনোলজি কলেজের শিক্ষার্থী, সাধারণ শিক্ষার্থী, চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, দাফন ও সৎকারে সংশ্লিষ্ট মানুষ, বিদেশগামী মানুষ, চীনা নাগরিক, পুলিশ, বিজিবিসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, প্রশাসনসহ যারা করোনা মোকাবিলায় ফ্রন্টলাইনার হিসেবে কাজ করছেন তারা সবাই চীনের এই টিকা পাবেন। এছাড়া যারা এর আগে প্রথম ডোজ টিকা দেওয়ার জন্য আগে রেজিস্ট্রেশন করেছেন তারাও এই সিনোফার্মে টিকা পাবেন। তবে রাজশাহীতে যদি বড় পরিসরে গণটিকা কার্যক্রম চালানো যেতো। তাহলে চলমান ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট এভাবে সংক্রমণ ছড়াতে পারতো না বলেও মন্তব্য করেন সিভিল সার্জন ডা. কাইয়ুম।

ইউকে/এসই/এসএম